ডুয়ার্স শব্দটির মূলত উৎপত্তি “দুয়ার” শব্দ থেকে ৷ পূর্ব হিমালয়ের পাদভুমিতে অবস্থিত ডুয়ার্স পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চল ইন্দো- ভুটান পাহাড়ি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার বা দুয়ার । শুধুমাত্র বন্যপ্রাণীর চারণভূমি নয় , বিভিন্ন ঔষধি গাছগাছারি, প্রবহমান তিস্তা , জলঢাকা , মূর্তি , তোর্সা নদী ও চা বাগান সম্বৃদ্ধ উপত্যকা অঞ্চল ডুয়ার্স ।
তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বা ভ্রমণের গল্পে যাওয়ার আগে ডুয়ার্সের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন । ডুয়ার্সের মূল আকর্ষণ বিভিন্ন National Park, wildlife sanctuary, এগুলি পূর্ব ডুয়ার্স ও পশ্চিম ডুয়ার্সের মধ্যে বিভক্ত। গোরুমারা ন্যাশনাল পার্ক ও চাপরামারি অভয়ারণ্য পশ্চিম ডুয়ার্সের অন্তর্গত, আর পূর্ব ডুয়ার্সের অন্তর্গত জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক , চিলাপাতা ফরেস্ট এবং বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প ।
ডুয়ার্স ট্যুরের প্রথমদিন বরাদ্দ ছিল আমাদের বক্সা টাইগার রিজার্ভে সাফারির জন্য। আমরা আলিপুরদুয়ারে নেবে সোজা পৌঁছালাম রাজাভাতখাওয়াতে। দিনটা ছিল ২৫শে ডিসেম্বর, জাঁকিয়ে শীত পড়েছে, গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, ডাল, মাছ দিয়ে লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পরলাম জঙ্গল সাফারিতে। জঙ্গল সাফারির মূলত ৩টে সময় থাকে, ভোরবেলা, দিনেরবেলা আর দুপুর ৩টে নাগাদ। তবে কোনো বন্যপ্রাণী দেখতে হলে ভোরবেলা বা দুপুরবেলা যাওয়া ভালো। বক্সা টাইগার রিসার্ভের মূল আকর্ষণ watch tower। সেখানে salt pit থাকার জন্য পশুরা আসতেই থাকে। কথায় আছে, “সফর খুবসুরাত হ্যায় মাঞ্জিল সে ভি”।
আমাদের ও তাই হলো। জঙ্গলের পথে প্রথমেই দেখলাম এক barking deer, রাস্তা পার হচ্ছিল, আমরা দারিয়ে পড়লাম। তারপর দেখলাম একটা ছোট্ট খুঁটির ওপর বসে রয়েছে একটা ময়ূর। কিন্তু তারপর যা দৃশ্য দেখলাম তা সচরাচর দেখা যায়না। গাড়ি কিছুটা এগোতেই ময়ূরটা ডানা মেলে উড়ে গেল, অসম্ভব সুন্দর সেই দৃশ্য। তারপর ছোট্ট নদী পেরিয়ে গেলাম watch towerএ। চারিদিক নিস্তব্ধ, salt pitএ নুন খেতে এসেছিল sambar deer। তবে আমাদের watch towerএ পৌঁছনোর আগেই হাতি এসেছিল সেখানে তাই আমাদের শুধু হাতি আর বন্য শুকর দেখেই মন ভরাতে হলো। ফেরার সময় সন্ধে হয়ে গেছিলো, শুনেছিলাম ওখানে বাঘ আর লেপার্ড আছে, দেখার আশা নিয়ে উৎসুক চোখে চেয়েছিলাম চারিদিকে, কিন্তু আর কি ভাগ্য সহায় না দিলে
যা হয়।
জ্ঙ্গলের যায়গা সন্ধে ৬টার মধ্যে হোটেলেফিরতে হয়। তবে ২৫শে ডিসেম্বর থাকার জন্য ফিরে এসেও বেশ ভালো কেটেছিল। হোটেলের পক্ষ থেকে একটা পার্টি রাখা হয়েছিল, কেক কাটা থেকে শুরু করে dance in the floor with DJ সবই ছিল উপরি পাওনা। তাছাড়া হোটেলের নিজস্ব indoor games parlour আর gym থাকার জন্য টেবিল টেনিস, ক্যারাম আর বিলিয়ার্ড খেলে বাকি সময়টাও ভালোই কাটিয়েছিলাম।
পরদিন সকালে ঝটপট breakfast সেরে ওই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম, গন্তব্য চিলাপাতা ফরেস্ট। তবে প্রথমে আমরা গেলাম trekএ, জয়ন্তী পাহাড়। গাইডের সঙ্গে Buxa Tiger Reserve এর permission নিয়ে চললাম trekএ। শুধু মনোরম পাহাড়ি প্রাকৃতিক দৃশ্যই নয়, বিভিন্ন ঔষধি গাছগাছারি দেখা, তাদের সম্মন্ধে জানাও ছিল এই trek এর অংশ। জয়ন্তীর জঙ্গলে কি করে দাবানল লাগে তাও জেনেছিলাম গাইড দাদার কাছ থেকে। ৪০ মিনিট মতো পর পৌঁছেছিলাম পুকরি মাই তে, একটা ছোট্ট পবিত্র পুকুর যেখানে বিভিন্নি হিন্দু, বৌদ্ধ উৎসব পালিত হয়।আগে থেকে নিয়ে যাওয়া মুড়িও খাইয়েছিলাম ওই পুকুরের বড়ো বড়ো শিঙ্গি, মাগুর মাছকে, কচ্ছপকে খাইয়েছিলাম।সেখান থেকে নেবে জিপসি গাড়িতে আবার গেলাম ছোটা মহাকাল। মহাকাল গুহার নীচে ভারত ও ভূটানের মধ্যবর্তী পাহাড়ে অবস্থিত ছোটা মহাকাল, স্ট্যালাগটাইট ও স্ট্যালাগমাইট গুহা। এখানে এক, গুহায়ে পৌঁছানোর পথই ছিল উপভোগ করার মতো এককথায়ে adventurous। শীতকাল, বিশাল চওড়া মূর্তি নদীতে জল বইছে সরু সুতোর মতো, বাকি নদী পুরো সাদা, সাদা নুড়ি – পাথরময় নদীপথ সেখান দিয়েই আমাদের জিপসি গাড়ি এগিয়ে চলল, এমন পথ ছবি তোলা বা ভিডিও করা তো দূর অস্ত জিপসিতে স্থির হয়ে বসে থাকাই কঠিন। নদী পেরিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে জিপসি নামিয়ে দিল, এবার পায়ে হেঁটে পাহাড়ে উঠতে হলো, গুহা পর্যন্ত পৌঁছানোর পথ অনেকটা নয়, কিন্তু সংকীর্ণ, চারিদিকে শ্যাওলা, ঝরনার পাশ দিয়ে উঠতে হবে, পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর, শেষে দড়ি ধরে পৌঁছালাম স্ট্যালাগটাইট-স্ট্যালাগমাইট গুহাএ, নামবার পথে ছোট্ট ঝরনা ও ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে মূর্তি নদীর ধারে একটা হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম চিলাপাতা ফরেস্ট ক্যাম্পের উদ্দ্যেশ্যে, সেখানেই আমাদের রাত্রিযাপনের বন্দোবস্ত।
দুপুর ৩-৩০ নাগাদ পৌঁছালাম চিলাপাতা ফরেস্ট ক্যাম্পে। সেখানে নিজেদের রুম এ চেক ইন করে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গল সাফারির জন্য। সাফারি ভালো হবে না খারাপ তার অনেকটা নির্ভর করে জিপসি গাড়ির ড্রাইভার ও ফরেস্ট গাইডের ওপর। এটাও ছিল বিকালের সাফারি সঙ্গে ভালো ড্রাইভার ও গাইড, বন্যপ্রাণী দেখার সমুহ সম্ভাবনা। তাই চিলাপাতা ফরেস্ট সাফারিকে আমাদের ট্যুরের সবচেয়ে ভালো সাফারি বললে একটুও বারিয়ে বলা হবে না।
বিকাল ৪টে নাগাদ শুরু হলো সাফারি, কিছুদূর যাওয়ার পরেই হঠাৎ দেখি ড্রাইভার কাকু গাড়ি থামিয়ে দিলো, দিয়ে নেবে পরে গাইড দাদাকে সঙ্গে করে গাড়ি ঠেলতে থাকে, আমাদের নিয়ে, আমরা একটু ভয় পেয়ে যাই, যে গাড়ি খারাপ হয়ে গেল নাকি। গাইড দাদা বলে চুপ করে থাকতে, একটু এগিয়ে দেখায় জোড়া ময়ূর, ময়ূরকণ্ঠী ও বেগুনী রঙের সমাহার। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে জানতে পারি, গাড়ির শব্দে যদি পালিয়ে যায় তাই তারা আগেই দেখে গাড়ি থামিয়ে, ঠেলে নিয়ে গেছিলো আমাদের, গাড়ি থেকে নামতে দেয়নি অন্য জন্তুর ভয়ে, অবাক হয়ে শুনেছিলাম আর বুঝেছিলাম তারা ট্যুরিস্টকে কত ভালোবাসে।
চিলাপাতা জঙ্গলের অন্যতম আকর্ষণ বাইসন। এবার সেই গল্পে আসি। দূর থেকে কিকরে বুঝব পাতার ফাঁকে বাইসন আছে? গাইড দাদার কথাতেই বলি, “যদি কোথাও সাদা বক বা কাক এরম কোনো পাখি থাকে তাহলে সেখানে বাইসন থাকার সমূহ সম্ভাবনা। কারণ বক বা কাক এরা বাইসনের পিঠে বসে ও তাদের গা থেকে পোকা খুঁটে খুঁটে খায়” । উৎসুক চোখে চারিদিকে চেয়ে আমরা বাইসন দেখার জন্য। দু-চারটে বাইসন চোখেও পরেছিল পাতার ফাঁকে কিন্তু আসল ঘটনা ঘটে ঠিক তারপরে। চার-পাচঁটা বাইসন দেখই পাতার ফাঁকে, ড্রাইভার কাকু গাড়ি থামিয়ে দেয়। গাইড দাদা বলে এরা রাস্তা পার করবে তাই সামনে থেকে দেখতে পাবো। সামনে একটা জিপসি তারপর আমাদেরটা তারপর আর একটা। এবার ধীরে ধীরে বাইসন বেরোতে থাকে গাছের ফাঁক থেকে, দুটো বাইসন একদম সামনে আর তিনটে আশেপাশে।
চারিদিক নিস্তব্ধ, সবাই দেখাছি, ছবি তুলছি, হঠাৎ আমাদের পিছনের জিপসি গাড়ি থেকে একটি মেয়ে উঠে দাড়িয়ে ছবি তোলে ফ্ল্যাশ জ্বেলে, একটু অন্ধকার হয়ে আসার জন্য। ব্যাস, আলো দেখেই তেড়ে আসে একটা বাইসন। একটু হলেই সামনের গাড়িতে গুঁতো মারতো, আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কাকু পুরো তৈরি ছিল গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একটু গড়বড় হলেই বেরিয়ে পরবে গাড়ি নিয়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়েছিল। তিনটে গাড়ি, এতো মানুষ একসঙ্গে দেখে বাইসন আর তেড়ে আসেনি। ফিরতে ফিরতে চারিদিক পুরো অন্ধকার হয়ে গেছিলো, তাই জিপ্স্য গাড়ির চারিদিকে আগেই কভার দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধু পিছনের কভার তুলে দেখছিলাম অন্ধকার জঙ্গলপথে জোনাকির খেলা। গাড়ির হেডলাইটও বন্ধ, চারিদিকে শুধু টিপটিপ করে জ্বলছে জোনাকি, ভাষাএ বর্ণনা করা যায় না সেই দৃশ্য। ফেরার পথে শুনেছিলাম আমাদের ড্রাইভার কাকুকে নাকি তিনবার তাড়া করেছিল বাইসন, গাড়িতে গুঁতিয়েও দিয়েছিল একবার। তাই এবার সাত তাড়াতাড়ি গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে তৈরি হয়েছিল পালাবার জন্য। তারপর জঙ্গল ক্যাম্পে ফিরে কনকনে ঠাণ্ডায় ক্যাম্প ফায়ারের পাসে বসে হাত পা গরম করে দেশি মুরগির ঝোল আর রুটি দিয়ে ডিনার সেরেছিলাম।এই জায়গাএ একটা কথা বলা দড়কার সারা ডুয়ার্স ট্রিপের একটা বিশেষত্ব ছিল, রোজ রাতে দেশি মুরগির কষা মাংস।
পরদিন সকালে যথারীতি জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম অনেক দূরের পথ পূর্ব ডুয়ার্স থেকে পশ্চিম ডুয়ার্সে পাড়ি। গন্তব্য গোরুমারা। গোরুমারাতে সাফারির অনেক ভাগ আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে ভালো রাজাপ্রসাদ। যদিও সেখানে যাওয়ার পারমিট না পাওয়ায় যেতে হলো পরেরটায় অর্থাৎ দ্বিতীয় ভালো সাফারি মেদলা। যদিও মোষের গাড়ি চড়া ছাড়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছুই হলো না এখানে। দুরথেকে watch tower এ দাঁড়িয়ে একটি বাইসন দেখেই মন ভরাতে হলো গণ্ডার পাওয়া গেল না। চিলাপাতাতে সামনে থেকে বাইসন দেখে এখানকার বাইসন আর মনে ধরল না। ফিরে এলাম হোটেলে। গোরুমারাতে আমরা দু’দিন ছিলাম।
পরদিন গেলাম পাহাড় আর নদী দেখতে। এই ট্রিপটি ট্যুরিস্টদের কাছে seven points নামে পরিচিত। যদিও seven points দেখেছিলাম কিনা সেতা গুনে দেখিনি। প্রথমেই পৌঁছালাম মূর্তি নদীতে, পাথুরে নদীর চরায়ে মনোরম পরিবেশে কিছু সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের উদ্দেশ্যে শেষ গন্তব্য ভুটান বর্ডার। মূর্তি নদী পেরিয়ে চালসা হয়ে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চললাম ঝালং এর দিকে।
শিলিগুড়ি থেকে ৯৯ কিমি দূরে ইন্দ-ভুটান বর্ডারে জলঢাকা-র তীরে অবস্থিত ঝালং মূলত পূর্বে এলাচ চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু বর্তমানে ঝালং এর মূল আকর্ষণ জলঢাকা নদীর ওপর অবস্থিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি এমন এক প্রকল্প যেখানে শুধুমাত্র ভারত সরকার আনুমতি দেয় ড্যামটি ঘুরে দেখার। ড্যামটি ভুটান বর্ডারের এতো কাছে অবস্থিতিও হওয়ার জন্য এটি ভুটান যাওয়ার ব্রিজেরও কাজ করে। শীতকালে যাওয়ার জন্য দূরে সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়ার মতো বিরল দৃশ্য দেখার সৌভাগ্যও আমাদের হয়েছিল। যাওয়ার পাথুরে পাহাড়ি রাস্তা খারাপ হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল। ঝালংএ শুধুমাত্র ভুটানি নেপালি বা বাঙালি নয় মারোয়ারী আদিবাসী ও রাজবংশী সংস্কৃতির সম্মেলন ও দেখা যায়। ঝালং এখানকার মধ্যে বৃহত্তর বাজার হিসাবেও বিখ্যাত।এখানকার বিভিন্ন ভুটানি চকোলেট ও হাতে বোনা সোয়েটার টুরিস্টদের মূল আকর্ষণ।
আমাদের এর পরবর্তী গন্তব্য বিন্দু। বিন্দু ভারত ও ভুটানের মধ্যে প্রাকৃতিক বর্ডার তৈরি করে। এছাড়া ভারতের দ্বিতীয় সর্বপ্রাচীন বাঁধ এখানে অবস্থিত। এখানে টুরিস্টদের অন্যতম আকর্ষণ হলো বিন্দুখোলা, দুধ পোখরি ও জলঢাকা নদীর মিলনস্থল। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের জন্য বিন্দুতে আছে trekking ও hiking এর ব্যবস্থা। শহুরে কোলাহল পেরিয়ে নদীর তীরে বরফে ঢাকা পাহাড়ের কোলে প্রিয় মানুষদের সাথে সময় কাটানোর আদর্শ স্থান বিন্দু।
এরপর ফেরার পালা। পরদিন ফেরার পথে seven points এর আরো একটা point সবুজ বনে ঘেরা মূর্তি নদীর তীরে Rocky Island দেখে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম বাড়ি ফেরার জন্য। আসল কথা, “থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে”। সেই জগতের অতি ক্ষুদ্র অংশ ডুয়ার্স ভ্রমনের গল্পই নিজের মতো করে এখানে তুলে ধরলাম।