কোথায় গেল গয়নাগুলো! এখানেই তো থাকার কথা! আর কারেন্টটাকেও ছাই এই সময় যেতে হয়!

মোমবাতিটাকে উঁচু করে ধরে আলমারির তাকগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলো পিউ | নাহ..কোত্থাও নেই | কিন্তু গয়নাগুলো না পেলে তো মুশকিল হবে | অভির নামে করে রাখা মোটা টাকার ইন্সিওরেন্সটা হাত ফসকে গেলো না তো? | কিন্তু গয়না গুলো গেল কই.. 

(কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিলো পিউয়ের..) 

আরো ঘন্টাখানেক তোলপাড় করে খুঁজেও গয়নাগুলো খুঁজে পেলোনা পিউ | অভির মায়ের আর দিদার সব ভারী ভারী জড়োয়ার গয়না,একটাও নেই | তাছাড়া টাকাগুলো! কিছুদিন আগেই জমি কেনার পেপারে অভিকে সই করিয়ে পনেরো লাখের জায়গায় সত্তর লাখ টাকা তুলেছিলো পিউ | সেগুলো তো ও নিজের হাতে এই স্টোর রুমে ট্রলিতে ভরে রেখেছিলো | কিন্তু সেগুলোও নেই এখানে | আজ রাতের মধ্যেই বাড়ি ছাড়তে হবে পিউকে..আর তার আগে টাকা-গয়না গুলো খুঁজেনা পেলে এতদিনের সব চেষ্টা বিফল হয়ে যাবে | রুদ্রর সাথে এত প্ল্যান করে অভির মত একটা অন্ধ কুৎসিত ছেলেকে বিয়ে করা..তারপর তিলে তিলে অভিকে সর্বস্বান্ত করে নিজের আর রুদ্রর ভবিষ্যৎ গোছানোর জন্য এত যত্ন করে করা প্ল্যানটা পুরো ফ্লপ হয়ে যাবে | রাগে,হতাশায় দড়াম করে আলমারির পাল্লাটা বন্ধ করতেই আলমারির উপর থেকে ঠক করে একটা নোটবুক পিউয়ের পায়ের কাছে এসে পড়লো | 

 

অভির আঁকার খাতা | জন্মান্ধ অভি বাড়িতে বসে বসে ছাইভস্ম এঁকে খাতা ক্যানভাস বোঝাই করা ছাড়া আর কিছুই করতোনা|অভির বাবা অভির নামে ব্যাঙ্কে সত্তর লাখ টাকা রেখে গিয়েছিলেন|তার সুদেই সংসার চলতো অভি আর পিউয়ের | শ্বশুরমশাই অভির ছোটোবেলাতেই চোখ বুজেছিলেন|আর শাশুড়িমা পিউয়ের বিয়ের চারমাসের মাথায় সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে(ব্র়এন) হেমারেজ হয়ে মারা যান |পিউ এক লাথি মেরে খাতাটা সরিয়ে দিতে যাচ্ছিলো | এমন সময় খোলা জানলা দিয়ে একটা দমকা হাওয়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘরটায়..আর খাতার মলাটটা উল্টে প্রথম পাতাটা খুলে গেল | 

 

 “পাত্রী প্রচন্ড সুন্দরী..গজদাঁত”..আর থুতনির টোলটা দেখে নিজেকে চিনতে অসুবিধে হলনা পিউয়ের | অভি আর পিউয়ের পাকা দেখার ছবি! এত স্পষ্ট পরিষ্কার এঁকেছে অভি..না দেখেই! মন্ত্রমুগ্ধের মত পাতা উল্টালো  | 

 

পরের ছবি..কনের সাজে বসে মেয়েটি..পাত্রের মা গলায় পরিয়ে দিচ্ছে সীতাহার | ঠিক যেমন পিউকে দিয়েছিলো অভির মা | 

 

তৃতীয় ছবি | ফুলে ফুলে সাজানো ঘর | বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সদ্য বিবাহিতা মেয়েটি..পোষাক আলুথালু তার.. জড়িয়ে অলিঙ্গন  করছে একটি ছেলেকে | আর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অন্ধ ছেলেটি | মেয়েটির বর | গলা শুকিয়ে এল পিউয়ের | এ কি করে সম্ভব!অভি তো চোখে দেখতে পেতোনা! তবে ও কি করে জানলো যে সেদিন রাতে রুদ্র এসেছিলো এই বাড়িতে?উফফ্ সেদিন যে কি ভয় পেয়ে গিয়েছিলো পিউ..রুদ্রর সাথে আলিঙ্গনে  যখন ভেসে যাচ্ছে..তখনই হঠাৎ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলো অভি | এক মুহুর্তের জন্য পিউ ভুলেই গিয়েছিলো..অভি চোখে দেখতে পায়না৉

 

কিন্তু অভি জানলো কি করে?-যে সেদিন রাতে রুদ্র এসেছিলো এখানে! আর রুদ্রর উল্লেখ কোনো ব্যাপারে করেনি পিউ কখনো..তাহলে রুদ্রর ছবি কি করে এত নিখুঁত আঁকলো অভি! 

 

রুদ্ধশ্বাসে পাতা উল্টোলো পিউ | 

 

পরের ছবিতে সিঁড়িতে হাতের বাটি থেকে কিছু একটা ঢালছে মেয়েটি..

 

তার পরের ছবিতে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের উপর উপুর হয়ে পড়ে রয়েছে সেই বয়স্কা মহিলাটি..ঠিক সেইভাবে,যেভাবে অভির মা পড়েছিলেন ল্যান্ডিংয়ের উপর..পিউয়ের ফেলে রাখা তেলে পিছলে গিয়ে |

 

পিউয়ের আজও মনে আছে..কিভাবে কেঁদেকেটে লোক জড়ো করার আগে ও সিঁড়ি আর অভির মৃত মায়ের পায়ের তলা থেকে ঘষে ঘষে মুছে তুলেছিলো তেলের শেষ বিন্দুটুকু..

 

পরের ছবিটা একটা কোলাজ | বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলনা পিউয়ের | রুদ্রর লুকিয়ে বাড়িতে ঢোকার ছবি | অভির মা মারা যাওয়ার পর যখন তখন এই বাড়িতে আসতো রুদ্র | সেই সময়কার ছবির কোলাজে ভর্তি  পাতাটা | 

 

পিউ অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে |

 

পরের ছবিতে পিউ বেরোচ্ছে ব্যাঙ্ক থেকে..হাতে দু'টো বিরাট ট্রলি.

 

তারপরের পাতায় অভির গাড়ির ব্রেকে কারসাজি করছে রুদ্র..

 

পিউ অবাক হয়ে দেখলো..খাতাটা এখানেই শেষ নয়..তারপরও আরো কিছু পাতা আছে..

 

পরের পাতায় গাড়িটা চলন্ত..আর ড্রাইভারের সিট থেকে লাফিয়ে পড়ছে অভির ড্রাইভার! 

 

দমবন্ধ হয়ে এসেছে পিউয়ের | গায়ের প্রতিটা রোমকূপ যেন দাঁড়িয়ে গেছে...পরের ছবিতে গাড়িটা ধাক্কা মেরেছে একটা গাছে | পিছনের সিটে এলিয়ে পড়ে আছে অন্ধ ছেলেটা..মাথা থেকে টাটকা রক্ত গড়িয়ে পড়ে ভিজিয়ে দিয়েছে গাড়ির সিট |

 

তারপরের পাতাটা উল্টে যেন শক খেল পিউ | ছেলেটা উঠে বসেছে তার সিটে..আর কোন ভোজবাজিতে খুলে ফেলেছে তার এতদিন বন্ধ হয়ে থাকা চোখ..সে চোখে আলো নেই..আছে নরকের মত অনন্ত অন্ধকার | 

 

(খাতার আর একটা পাতাই উল্টোনো বাকি..)

 দমবন্ধ করে সেটা উল্টোলো পিউ | শেষ ছবিতে একটা মেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আছে মেঝেতে | হাতে একটা মোমবাতি | সামনে খোলা খাতা | আর তার ঠিক পিছনেই মুখে পৈশাচিক হাসি আর অন্ধকার চোখে যতরাজ্যের ঘৃনা নিয়ে দরজা আড়াল করে এসে দাঁড়িয়েছে দু-পাতা আগে মৃত অন্ধ ছেলেটা! ছবির ঘরটার সাথে এই ঘরটার যেন বড় মিল! 

 

অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠে খাতাটা বন্ধ করে মেঝে থেকে উঠতে গিয়েই সামনের দেওয়ালে চোখ পড়লো পিউয়ের | মোমবাতির আলোয় সামনের দেওয়ালে ও কার ছায়া পড়েছে! ঘাড় ঘোরাতে পারছেনা পিউ | একটা খসখসে আওয়াজে বুঝতে পারছে..সে পা টেনে টেনে এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে! 

 

একটা দমকা হাওয়ায় মোমবাতিটা নিভে গেল!