আজ সকাল সকাল শৈলেশের চিঠিটা পেয়ে মনটা বেশ নেচে উঠল । আমার সেই শৈশবের বন্ধু শৈলেশ ভট্টাচার্যর আজ আবার আমাকে মনে পড়েছে। শৈলেশ ছিল আমার ক্লাসমেট, শুধু তাই না কলেজও এক ছিল কলেজও এক। তাই স্কুল কলেজের বেশ কিছু মধুর স্মৃতি ছিল আমাদের । 

          আগেই জানিয়ে রাখি আমি পেশায় একজন সম্পাদক, বই ছাপাই এবং বাড়িতে আমি একাই থাকি। হ্যাঁ, আমার ভৃত্য রামহরিও আমার সাথেই থাকে। তাই রায় পাবলিশিং হাউসের একজন প্রধান সম্পাদক হবার কারণেই রোজ আমার বাড়ির ডাকবাক্স একেবারে পরিপূর্ণ থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন মানুষ তাদের বই ছাপাবার অনুরোধে আমায় সেসব চিঠি লিখে থাকে।যাই হোক সে সব চিঠি রামহরিই ডাকবাক্স থেকে বের করে আমার কাছে নিয়ে আসে। আমিও প্রয়োজনমতো জবাব দিই সেগুলোর। 

      তবে আজ সে জিনিসের অন্যথা হলো। শৈলেশের চিঠি নিয়েই ঘটল সে কান্ড।সকাল সাতটা নাগাদ রামহরি এসে বললো আজ ডাকে কোনো চিঠি আসেনি। যাক ভালই হলো এক দিক থেকে, মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে যে সকাল সকাল চিঠি পড়ার কাজটা আজ আর রইল না। 

  রোজ সকালেই আমি মর্নিংওয়াকে যাই । আজও বেরোচ্ছিলাম। তবে বাড়ি থেকে বেরোতেই পোস্ট-বক্সটার দিকে চোখ পড়ল।দেখলাম একটা চিঠি সেখান থেকে উঁকি মারছে। 

          ডাকবাক্স খুলে বের করলাম চিঠিটা। খামের ওপর লেখা-“শৈলেশ ভট্টাচার্য, বৈদ্যবাটি”। নামটা দেখেই মনটা কেমন যেন পুলকিত হয়ে উঠল। চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল স্কুল কলেজে আমার প্রিয়সখা শৈলেশের সঙ্গে কাটানো হাসি-ঠাট্টার মধুর মুহূর্তগুলো। আহা…সে কি দিন ছিল।

       উত্তেজনার বসে বাড়িতে ফিরে খাম থেকে চিঠিটা বের করলাম-

“প্রিয় অসীম

অনেকদিন ধরেই তোকে একটা চিঠি লিখব বলে ভাবছিলাম কিন্তু সময় হয়ে উঠছিল না। চাকরি সূত্রে আমরা বৈদ্যবাটিতে ট্রান্স্ফার হয়েছি। চাকরি পাবার পর প্রথম কদিন আমাকে চিঠি লিখ্তি তুই-এখন সেটাও আর লিখিসনা। যাই হোক আমিই না হয় যোগাযোগ পুনরায় স্থাপন করলাম। বৈদ্যবাটি জায়গাটা বেশ নিরিবিলি জানিস। যদি হাতে সময় থাকে একবার আসিস আমার সাথে দেখা করতে। আশা করি তোর এই বন্ধুর অনুরোধটা রাখবি তুই।

আমার বাসস্থানে তোর উপস্থিতির অপেক্ষায় থাকব।

                      ইতি

                    শৈলেশ।“

মনটা খানিকটা দুঃখিত হয়ে গেল। বেচারা ঠিকই তো বললো ,কাজের চাপ এতটাই বেড়ে গেছে যে নিজের পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সাথেও যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেছে।সত্যিই চাকরি পাবার প্রথম কদিন ওকে চিঠি লিখতাম আমি। সেও জবাব দিত। এখন কাজের চাপে সে যোগাযোগের মাধ্যমটাও চাপা পড়ে গেছে।নিজের ওপরেই রাগ হলো প্রচন্ড।

         মনস্থির করে নিলাম কাল সকালেই রওনা দেব বৈদ্যবাটির উদ্দেশ্যে।

   পরে রামহরিকেও একটু বকাঝকা করেছিলাম চিঠিটা দেখতে পায়নি বলে। কিন্তু তাও একটা খটকা লাগছিল আমার। রামহরির দৃষ্টিশক্তি এতটাও কমজোর হয়ে যায়নি যে পোস্টবক্স এর একটা জলজ্যান্ত চিঠিকে সে দেখতে পাবেনা। তবে কি চিঠিটা শৈলেশ শুধু আমাকেই দেখাতে চেয়েছিল? ধুর…অমনি আবার হয় নাকি।

   চিঠিটা আরও একবার উল্টে পাল্টে দেখলাম। একটা ঠিকানা চোখে পরল-

   8/0 শ্রীনিবাস রোড

    বৈদ্যবাটি।

চিঠি সমেত খামটা পকেটে ভরে নিলাম। ভুলে গেলে কাজে লাগতে পারে।উত্তেজনায় আত্মহারা হয়ে উঠছিলাম মাঝে মাঝেই। আবার সেই পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হবে।আবার স্কুল কলেজের চিরস্মরণীয় স্মৃতিগুলো ফিরে পাবো। আহ,আর যেন তর সইছে না।

        পরদিন সকাল ছটায় বাড়ি থেকে রওনা হলাম। বেরোনোর সময় রামহরি আরও কয়েকটা রহস্যজনক কথা বলেছিল আমায়। যদিও সেসবে বেশি কান দিইনি আমি।

          ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরোতে যাবো এমন সময় রামহরি বলে উঠল-“আজ্ঞে একটা কথা বলবো বাবু?কাল সুনীলের সাথে দেখা হয়েছিল বাজারে“ সুনীল আমাদের পাড়ার পোস্টম্যান। আমাদের পাড়াতেই থাকে।

        আবার বললো রামহরি-“তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে সকালের ডাকে কোনো চিঠি এসেছিল কিনা। তবে সে যে বললো,সে নাকি আজ আপনার বাড়িতে চিঠি দিতে আসেইনি”

“মানে টা কি?” আমি বললাম।

“মানে আজ কোনো চিঠিই আসেনি”

“কিসব গাঁজাখুরি বকছ হে রামহরি।আমার মাথাটা খারাপ করোনা আমি বেরোচ্ছি।“

“না বাবু…“আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, আমি থামিয়ে দিলাম।

তাকে হয়ত বলতে দেওয়া উচিত ছিলো।

 

হ্যাঁ, আমি শ্রী শৈলেশ ভট্টাচার্য। এখন আর বোধহয় মানুষ এর পর্যায়ে ফেলা যায়না আমাকে। মালিনী কর্কট রোগে দেহত্যাগ করলো গত পরশুদিন, এই ত্রিভুবনের আমার একমাত্র সঙ্গীও আমায় ছেড়ে পালালো। বৈদ্যবাটির ডাক অফিসে এখন রোজ একটা প্রাণহীন শরীর কেবল যায় আর আসে, কথা বলাও যেন ভুলে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে সকল ষড়রিপুর মোহজালে জড়িয়ে যেতে থাকলাম, নকুল দুবেলা খাবার বানিয়ে যায় এবং ক্ষুধার্থ পশুর মতো তা গোগ্রাসে গিলে যাই আমি। কাছেপিঠের নিষিদ্ধ পল্লী তেও যাওয়া আসা শুরু হলো আমার। ধীরে ধীরে অফিসে যাওয়াও বন্ধ করে দিলাম। এই রাজপ্রাসাদে এক জ্যান্ত লাশের মতো ঘুরে বেড়াই সারাদিন, মদ্যপানে বেহুস হয়ে প্রায়ই অকথ্য গালিগালাজ করি নকুলকে, তবে কেন জানিনা তবুও সে আমায় ছেড়ে যায়না! কেন যায়না! কেন! আমি তো একাই থাকতে চাইছি।

ক্রমশ সুস্থসবল শরীরটাও ভেঙে পড়তে থাকল। বই পড়ার অভ্যেসটা ছাড়িনি, মাঝে মধ্যেই দোতলার লাইব্রেরি তে গিয়ে পরে থাকতাম। সেখানেই সন্ধান পেলাম এক অমূল্য রত্নের, এক গোপন তন্ত্রের। ধীরে ধীরে ডুবে গেলাম কালো জাদুর সেই অদ্ভুত অশুভ জগতে। এখন আমার অনেক সঙ্গী, অনেক বন্ধু তবে তারা কেউই রক্ত মাংসের মানুষ নয় – কেউ অশরীরী, তো কেউ অশরীরীদের অনুচর। বাদুড় ও শেয়ালেরা এখন বাল্যবয়সী ছেলেময়ের মতো খেলা করে বেড়ায় আমার এই প্রাসাদ জুড়ে। জীবনের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট যেন ঘুঁচে যেতে থাকল। স্বর্গীয় সুখে প্রায় আচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছিল জীবনটা। তবে মাঝে মধ্যেই ইচ্ছা করত তাঁদের দলেই কোনরকমে মিশে যেতে। কিন্তু এই পচে যাওয়া শরীর নিয়ে দরজার ওপারে যাওয়া যে অসম্ভব তা ভালোই বুঝতে পারতাম।

তাই আমি নিজে হাতেই সে দরজা খুলে ফেললাম। জীবনে আর সুখের অভাব রইলনা.....।।

 

   লোকাল ট্রেন ধরলে এক ঘণ্টাতেই পৌছে যাবার কথা বৈদ্যবাটি। তবে আজ ট্রেন লেট করল। বৈদ্যবাটিতে যখন নামলাম তখন বেলা বারোটা। স্টেশনের বাইরে চার পাঁচটা রিক্সা দাড়িয়ে।তারই মধ্যে একজনের কাছে গিয়ে ঠিকানা টা বললাম। পালটা প্রশ্ন করল লোকটা-“ওখানে কে থাকে বাবু আপনার?”

“সে জেনে তুমি কি করবে। যাই হোক আমার এক বন্ধু থাকে সেখানে শৈলেশ ভট্টাচার্য।“

লোকটা ভুত দেখার মতো চমকে উঠল ”কি ভট্টাচার্যর বাড়ি?”

“কেন ওখানে যেতে কিছু অসুবিধা আছে?”

 

“না না কিছু না। চলেন বাবু। “, উঠে বসলাম রিক্সায়।

    সত্যিই বেশ নিরিবিলি জায়গা বৈদ্যবাটি। নানা ধরনের রঙিন পাখি দেখতে পেলাম রাস্তায়। এখানকার হাওয়ায়  বেশ শান্তির অথচ রহস্যের গন্ধ্য মিশে আছে। পনেরো মিনিট পর রিক্সাটা একটা নির্জন প্রায় ভাঙা পোড়ো বাড়ির সামনে এসে থামল। সামনের গেটের পর বেশ কিছুটা  জমি ফাঁকা,দুদিকের আগাছা ও ঘাস দেখে বুঝলাম আগে হয়ত বাগান জাতীয় কিছু ছিল সেখানে।

        বাড়িটাও বেশ পুরনো,অনেকটা রাজবাড়ির মতো দেখতে। হাইস্কুলে ফেল করা সেই ছেলেটার যে এত বড়ো একটা বাড়ি আছে তা যেন বিশ্বাস হচ্ছিলনা। সম্ভবত নিজের পয়সায় বানায়নি বাড়িটা। তবে এ বাড়ির দামও প্রচুর হবে। যাই হোক রিক্সার ভাড়া চুকিয়ে আগাছার ঝোপের মধ্য দিয়ে এগোতে লাগলাম।

     কড়া নাড়তেই একজন ভৃত্য জাতীয় লোক দরজা খুলল-“আপনি রায়বাবু?”

“অজ্ঞে হ্যাঁ”

“ভেতরে আসুন”-বাইরে থেকে পোড়ো বাড়ি মনে হলেও ভেতরে রাজশাহী ব্যাপার। এ একেবারেই অপ্রত্যাশিত। বাইরে থেকে পলেস্তরা খসে পড়া, ইঁট বের করা বাড়ি অথচ ভেতরের পরিবেশ একেবারে ছিমছাম।

“বাবু নিজে হাতে সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে আপনার জন্য। ওখানে বসুন।“, ভৃত্যটা একটা আরামকেদারাকে নির্দেশ করে বললো।

“আচ্ছা তোমার নাম কি হে?“, প্রশ্ন করলাম।

“আজ্ঞে অধমের নাম নকুল।“, এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

      খানিক্ষণ পরে ওপরের সিড়িতে  শব্দ পায়ের শোনা গেল। পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে একজন ভদ্রলোক নেমে এলো। সত্যিই সেই ঠাট্টামার্কা ছেলেটা আর নেই সে এখন সত্যিই ভদ্রলোক।

“কিরে চিনতে পারছিস তো?”, কন্ঠস্বরেও বেশ পরিবর্তন ঘটেছে।

“বাবারে তুই যে একেবারে সাহেব হয়ে গেছিস। চুল দাড়িতেও পাক ধরেছে দেখছি!“ , বলল শৈলেশ।

“কাজকর্মের চাপে আর শরীরের যত্ন নেবার সময় কোথায় পাই”, বললাম।

“তা যা বলেছিস। তা একবার যখন এসে গেছিসই আর ছাড়ছিনা তোকে”, হাসি মুখে বলল শৈলেশ।

‘বাবারে তাই নাকি?”

“যদি বলি তোকে সারাজীবন আমার সাথে এই প্রাসাদে থেকে যেতে হবে…থাকবি? নাকি রাজি হবিনা?”, শৈলেশের কন্ঠস্বর কেমন যেন একটু অদ্ভুত শোনাল। সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল সে আমার দিকে।

ঘোরটা কাটিয়ে বললাম,”রাজি হবনা কেন। নিশ্চই থেকে যেতে পারি তোর সাথে সারাজীবন।“

“তাহলে চ”

“কোথায়?”

“কোথায় আবার ।খাবিনা নাকি?”

 

দুপুরের ভোজনেও ছিলো রাজশাহি ব্যাপার-ভাত,ডাল,  তরকারি,মুরগির মাংস। শেষ পাতে দই খেয়ে, পান চিবোতে চিবোতে ঘরে ফিরে এলাম।

আমাকে দক্ষিণ দিকের একটা ঘর দেওয়া হয়েছিল দোতলায়। ঘরের পেছনের জানলা দিয়ে বাড়ির পিছনদিকটা দেখা যায়। পিছনদিকটায় একটা ছোট দিঘি,মধ্যাহ্নর উত্তপ্ত রৌদ্র সেই দিঘির জলে প্রতিফলিত হয়ে এক অসাধারণ আলো ছায়ার নকসা এঁকে দিচ্ছিল।

            পিছনের সেই জানলার পাল্লার নিচের দিক থেকে অনেক্ষন ধরেই একটা শব্দ পাচ্ছিলাম-ঠিক পাখির ছানার চুঁই চুঁই শব্দের মতন। ভাবলাম অনেকদিন ফাঁকা পরে আছে ঘরটা সেই দেখে হয়তো কোনো পাখি বাসা বেঁধেছে সেখানে।

     জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নিচে তাকালাম। তৎক্ষণাৎ দুটি পাখির মতো প্রাণী ডানা ঝাপটে উড়ে গেল দিঘির দিকে। হঠাৎ যেন মনে হলো সেগুলো পাখি নয়,বাদুড় জাতীয় কোনো প্রাণী।

     

প্রথম ঘটনাটা ঘটল সেদিন রাতে। সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম। বাইরে যাইনি আর। ভেবেছিলাম নতুন জায়গা, কাল নাহয় আশপাশটা একটু ঘুরে দেখে আসব। আগেও অনুভব করেছি,এ বাড়িতে এসে থেকেই কেমন যেন একটা চাপা অস্বস্তি আমায় চেপে ধরেছে। সন্ধ্যে নামতেই বৈদ্যবাটির পরিবেশটা কেমন যেন একটু গা ছমছমে হয়ে উঠল। সারা দুপুর জেগেই ছিলাম। শৈলেশ একটিবারও আমার ঘরে আসেনি।

এখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। এতক্ষণে একবারও শৈলেশ বা নকুল আমার ঘরে এসে জিজ্ঞেস করেনি যে আমার কিছু প্রয়োজন কি না আমার খিদে পেয়েছে কি না ইত্যাদি।

    দুপুরবেলা তো অতিথি আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি ছিলো না। তবে সন্ধ্যে নামতেই এমন কি হলো। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল এ বাড়িতে যেন আমি একাই আছি। আরও দুই ব্যক্তি যে সশরীরে এই বাড়িতে উপস্থিত আছি তা বিন্দুমাত্র মনে হচ্ছিল না আমার। শৈলেশ ও নকুলের উপস্থিতি যেন হঠাৎই লোপ পেয়েছে এ বাড়ি থেকে।

      সারা দুপুর জেগে থেকেও কারও কন্ঠস্বর শুনতে পাইনি আমি। চারিদিক যেন এক অমানবিক ও নরকীয় নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। কোথায় গেল ওরা?বিকেলে এক কাপ চা ও দিয়ে গেল না,এ আবার কেমন অভদ্রতা।

          মাঝে মাঝেই লক্ষ করছিলাম,পিছনের জানলার নিচের বাদুড়গুলোর চুঁই চুঁই শব্দ যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তারই সাথে বেড়ে চলেছে তাদের অবিশ্রান্ত ডানা ঝাপটানোর শব্দ। বুকের ভেতর অস্বস্তিটা বেড়েই চলেছে।

  কিছুক্ষণের মধ্যেই শব্দগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। রোজই হয়তো বাদুড়ের উৎপাত হয় এখানে। বাইরের সিড়িতে একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাবার উপক্রম। সিড়ির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শুনে একবার মনে হলো নকুল হয়তো রাতের খাবার দিতে আসছে। কিন্তু শব্দটা যেন আর এগিয়ে আসছেনা, একই জায়গায় থেমে আছে। এইভাবে পাঁচটা মিনিট কেটে গেল, কোথায় নকুল কোথায় শৈলেশ। শুধুই বাদুড় আর বাদুড়।

 

হঠাৎ করেই কেমন যেন একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আমায় গ্রাস করে ফেলল। ঘুমিয়ে আছি না জেগে আছি বুঝতে পারলাম না।

      মনে হতে লাগল যেন জানলার ওপারের বাদুড়গুলো কোনোভাবে জানলার কোনো এক ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। চতুর্দিকে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা। আমি খাটের এক কোণে ভয়ে তটস্থ হয়ে বসে রইলাম, ত্রাণকর্তা বিপদ্তারণের নাম স্মরণ করতে লাগলাম। বাদুড়ের ধারালো ডানাগুলো অনবরত আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। সারা গায়ে কেউ যেন আঁচড় কাটছে। এ কি ঘোরে আচ্ছন্ন হলাম আমি।

           বাদুড়ের ডানার শব্দে আর যেন টেকা যাচ্ছেনা। মনে হতে লাগল যেন পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে সব বাদুড় যেন আমার এই ঘরে এসে জমা হয়েছে। এই ভাবেই কেটে যেতে লাগল মিনিটের পর মিনিট।

     কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি।

 

সকালে উঠে আগেই সেই জানলার দিকে চোখ গেল। দেখলাম কে যেন শত শত আঁচড় কেটে দিয়ে গেছে কাঁধের ওপর। কাল রাত্রের কোনো ঘটনাই ঠিক মনে পড়ছে না। সারা শরীরেও কোথাও ক্ষতচিহ্ন খুঁজে পেলাম না। শুধুই মনে পড়ল হাজার হাজার বাদুড়ের কোলাহল। তারা জানলার কাঁচে ধাক্কা দিচ্ছে। হিংস্র তাদের মুখ, ক্ষুধার্থ তাদের চোখ। তারা যেন ভেতরে আসতে চাইছে। অনবরত তাদের ডানা দিযে কাঁচের ওপর আঁচড় কাটছে…ওহ সে কি দৃশ্য! একবার মনে হলো সবই যেন আমর মনের ভুল, আমি হয়তো কেনো দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

 

“কাল রাতে খাবার দিতে এলেনা কেন?”,  খাবার টেবিলে প্রশ্ন করলাম নকুলকে।

“আজ্ঞে বাবু আপনিই তো বললেন যে খাবেননা। ঘুমিয়ে পড়লেন তারপর”-হেসে হেসে জবাব দিল নকুল।

এ বাড়িতে কি সবাই পাগল। নাকি আমারই স্মৃতিভ্রম হচ্ছে। 

বললাম-“আমি সারা দুপুর সারা সন্ধ্যে জেগে ছিলাম বুঝলে। তোমাদের কারও টিকিটুকুও দেখতে পাইনি বিকেলের পর থেকে। এক কাপ চা তো দিয়ে যেতে পারতে!”

“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে বাবু।নিন খেয়ে নিন। অনেক খিদে পেয়েছে বোধহয় আপনার।“

সত্যিই প্রচুর খিদে পেয়েছিল। কতক্ষণ কিছুই মুখে দিই নি।

 

খাবার পর শৈলেশের সাথে হাঁটতে বেরলাম। বলল আশপাশটা ঘুড়িয়ে দেখাবে আমায়। কাল রাতের ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে বললাম ওকে। সব শুনে ও এমন একটা ভাব দেখাল যেন এ অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার।

“তুই ভয় পেয়ে গিয়েছিলি নাকি?”, প্রশ্ন করল উল্টে।

“তো পাবোনা।মানে এমনি ভূতুড়ে সব ব্যাপার ঘটল। আমি তো রীতিমতো চমকে গেছিলাম এসব দেখে”

“আরে ভাই এখানে বাদুড়ের উৎপাত একটু আছে বটে। তবে তুই যা সব গাঁজাখুরি বললি, বাদুড়ে আঁচড় কাটছে,ঘড়ের ভেতর বাদুড় ঢুকে গেছে…এসব শুনে তো মনে হচ্ছে তুই একটা বড়োসড়ো দুঃস্বপ্ন দেখেছিস।“এই বলে হেসে উঠল শৈলেশ।

“কি বললি দুঃস্বপ্ন…”, মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে কাল রাতের সব ঘটনা সত্যিই আমার মনের ভুল।

এই পাড়াটা ঠিক উন্নত হয়নি তেমনভাবে। দেখে তো তাই মনে হলো। কাঁচা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে শুরু প্রকান্ড ধানের ক্ষেত। এখানকার আবহাওয়ায় শরীরটা বেশ চাঙ্গা হয়ে গেছে লক্ষ করছিলাম। আজ সকাল থেকেই আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন ; দুপুরের দিকে বৃষ্টি হলেও হতে পারে।

কাঁচা রাস্তার শেষে একটা বেঞ্চিতে বসলাম আমরা। আশপাশটা সত্যিই বেশ শান্ত। ইচ্ছা করছিল সারাজীবন এখানেই থেকে যাই ।

“কিরে কেমন লাগছে বৈদ্যবাটি?”, হঠাৎ জিজ্ঞেস করল শৈলেশ।

“বেশ ভালো। আচ্ছা একটা কথা বলত। কাল সারা সন্ধ্যে তুই কি করছিলি। হ্যাঁ মানলাম তুই রাতে জলদি শুতে যাস, কিন্তু সন্ধ্যে বেলায় তো একটিবার আমার ঘরে আসতে পারতিস“, বললাম  আমি।

“তুই কি বৈদ্যবাটির সৌন্দর্য দেখে রীতিমতো পাগল হয়ে গেলি নাকি। কাল তো সারা সন্ধ্যে  তুই ঘুমাচ্ছিলি। তুই তো নিজেই বললি যে তুই টায়ার্ড তাই একটু রেস্ট নিবি,“এবার সত্যিই ভয় হতে লাগল আমার। আমি কি সত্যিই পাগল হয়ে গেলাম। দু-দুজন মানুষ একই কথা বলছে অথচ আমর স্পষ্ট মনে আছে কাল সারাসন্ধ্যা আমি জেগে ছিলাম। হাজার ডেকেও কোনো সারা পাইনি ওদের। রাতেও কিছু খাইনি। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না কেন?

কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলাম।

“কিরে চুপ করে গেলি কেনো। চ তোকে এখানকার ডাবের জল খাওয়াব। তুই এখানে বোস আমি নিয়ে আসছি।“, এই বলে উঠে ডানদিকে  হাঁটা লাগাল শৈলেশ। কোথায় যে গেল তাও দেখতে পেলাম না।

 

ক্ষানিক্ষণ পর একটা লোক কে দেখতে পেলাম। মাঠের দিক থেকে কাঁচা রাস্তায় উঠে এলো লোকটা। বোধহয় এ গ্রামেরই বাসিন্দা।

“এই যে মশাই আপনাকে তো এখানে আগে দেখিনি?”, হঠাৎ প্রশ্ন করল লোকটা।

হঠাৎ করে এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। বললাম,”আজ্ঞে আমি থকিনা এখানে। ঘুরতে এসেছি এক বন্ধুর বাড়িতে”

“তা কার বাড়িতে উঠেছেন?”, আবার এক অদ্ভুত প্রশ্ন।

“শৈলেশ ভট্টাচার্য। চেনেন তো নাকি?”, একটু গম্ভীর স্বরে বললাম।

“কিসব বলছেন দাদা, ভট্টাচার্যবাবুর বাড়িতে…”, প্রবল অট্যহাস্য করে বললো ভদ্রলোক।

হাসি থামিয়ে আবার বলল,”সেলসম্যানের মৃত্যুর ঘটনাটা শোনেননি নাকি আপনি? হ্যাঁ…মনে হয় সত্যিই শোনেননি। নাহলে সকাল সকাল এমনি ঠাট্টা কেও করে..হা হা..”, আবার হেসে উঠল ভদ্রলোক।

 

সেলসম্যান? মৃত্যু? কিসব বলছে লোকটা। এ আবার কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা।

বললাম,“কিসব বলছেন? আরে শৈলেশ আমার বন্ধু। সে নিজেই আমাকে নেমত্তন্ন করেছিল তার বাড়িতে আসার জন্য। আর এই সেলসম্যান আবার কে?”

পুরোপুরি ধোঁয়াশায় ঢেকে যাচ্ছি আমি আস্তে আস্তে।

“থাক মশাই। আর মশকরা করার সময় নেই আমার হাতে। অনেক কাজ আছে। আপনি বরং অন্য কারোর সাথে এই সব ঠাট্টাবাজি করবেন। আসি আমি…”, একই ভাবে হাসতে হাসতে পাড়ার ভেতর দিকে চলে গেল লোকটা।

আমি শৈলেশের বাড়িতে আছি। এতে আবার হাসির কি হলো, হাজার ভেবেও তা বুঝতে পারলাম না।

আর আমি যে শৈলেশের বাড়িতে আছি এটা লোকে ঠিক মেনে নিতে পারছেনা কেন। প্রথমে সেই রিকশাওয়ালা তার পর এই লোকটা। আসল ব্যাপার টা কি?

     কয়েক হাজারটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। কিসব বলে গেল লোকটা।যা বলল তা কি সত্যি নাকি সবই গাঁজাখুরি। ইতিমধ্যে শৈলেশ দুটো ডাব নিয়ে ফিরে এলো।তাঁকে সব বললাম। সে তো সব শুনে সেই লোকটা কে পাগল বলে ঘোষণা করল। তার সাথে আর তর্কে গেলাম না। ফিরে এলাম শৈলেশের আস্তানায়।

 

আসল ঘটনাটা ঘটল সেদিন রাতে।