আজও দুপুরে বেশ সুস্বাদু খাবার পদ রান্না করেছিল নকুল। অবশ্যি একা হাতে সে এতকিছু যে কিভাবে রাঁধে তা আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। যাই হোক আজ দুপুরে টানা ঘুম দিলাম। আগে থেকেই আজ এক ফ্লাক্স ভর্তি চা নিয়ে রেখেছি , যদি আবার কালকের মতো ঘটনা ঘটে। নকুল অবশ্য প্রথমে বানাতে চায়নি, বলছিল সন্ধ্যে বেলা নিজে এসে চা দিয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করিনি তার কথায়।

যাই হোক রাত নামতেই আবার সেই নীরবতা। চারদিক আবার কাল রাত্রের মতো নিস্তব্ধ। উঠে পড়ে আগেই এক কাপ চা খেয়ে নিলাম ফ্লাক্স থেকে। কি অদ্ভুত না? নিজের বন্ধুর বাড়িতে এসে ফ্লাক্স থেকে চা খেতে হচ্ছে।

       পিছনদিকের খোলা জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দিঘির দিকটা দুর্ভেদ্য অন্ধকারে ঢাকা। থেকে থেকে জোনাকি জ্বলে উঠছে সেখানে। জানলা দিয়ে আসা শীতল বাতাস কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমার। বেশ আরাম লাগছিল। ভাবলাম শৈলেশের সাথে একটু গল্পগুজব করে আসি।

        ঘরের বাইরে যেতেই সিঁড়িতে সেই কালকের শব্দ টা শুরু হলো। সেই এক নাগাড়ে ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ।  এবার একরকম সাহস করেই সিড়ির দিকে এগোলাম। সিড়ির কাছে গিয়েই দেখ্তে পেলাম একটা মানুষকে। অন্ধকারে ঠিক চেনাই গেল না। গলার স্বরে চিনতে পারলাম -নকুল। তবে এই দীর্ঘকায় শরীর নকুলের কিভাবে হতে পারে। লক্ষ করলাম নকুলের শরীরটা আয়তনে খানিকটা লম্বা হয়ে গেছে। পা গুলোও অস্বাভাবিক রকম লম্বা মনে হচ্ছে।

  “আজ্ঞে কিছু লাগবে বাবু?”, প্রশ্ন করল।

“না” বিরক্তির সুরে উত্তর দিলাম। বললাম,”তা কিছু বলার ছিলো নাকি?উপরে এলে যে। আর শৈলেশই বা কোথায়?একটু আড্ডা মারতাম।“

“আজ্ঞে বাবু তো এখন স্নানে গেছেন। আর রাতে আপনি ভাত খাবেন না রুটি, সেইটাই জানতে এসেছিলেম বাবু।“  বলল সে।

      বেশ রেগে উঠলাম। বললাম,”আচ্ছা রাত হলেই কি তোমার বাবুর যত রাজ্যের কাজ মনে পরে? আর এই সময় কেই বা স্নান করে হ্যাঁ? কাল রাতেও তো তাকে দেখতে পেলাম না। আজ রাতেও অন্য এক ওজুহাত দিচ্ছ। বলছি তোমরা সব রাত হলেই পাগল হয়ে যাও নাকি…”

ফিসফিসিয়ে বললো নকুল-“আজ্ঞে বাবু…আসল কাজ তো রাতেই হয়”

“মানে?”

উত্তর দিলনা। এরপর যা করল তা একেবারেই অবিশ্বাস্য। আবছা অন্ধকারে মনে হলো যেন নকুল এক লাফে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। সিড়ি বেয়ে নামার কোন শব্দও পেলাম না। এও কি সম্ভব -এতগুলো সিড়ি এক লাফে ডিঙিয়ে কেউ কি নিচে নেমে যেতে পারে? নীচে তাকিয়েও যেন নকুলকে আর দেখতে পেলামনা। শুধু সিঁড়ির নীচে একটা অস্পষ্ট এবং অত্যন্ত লম্বা মানুষের অবয়ব দেখতে পেলাম। সাধারণ মানুষের কি অত বড়ো শরীর হতে পারে?

       যাই হোক ফিরে এলাম ঘরে। ব্যাগ থেকে একটা গল্পের বই বের করে পড়তে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আরেক কাপ চা খেয়ে নিলাম। এ যেন কোনো ভুতুড়ে বাড়িতে রাত কাটানোর মত। মনেই হচ্ছিল না যে আমি আমারই বন্ধুর বাড়িতে ঘুরতে এসেছি।

         পাঁচ মিনিট একভাবে পড়ার পর আবার বাঁধা পড়ল। সেই কালকের চেনা শব্দ।চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই শব্দ যেন ছাপিয়ে উঠছে।

        এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে বাদুড়গুলো জানলার পাল্লার নীচ থেকে। সেই অসহ্যকর চুঁই চুঁই শব্দ। আহ,কান ফেটে যাচ্ছে সেই শব্দে।

      জানলার বাইরে তাকিয়ে তাদের দেখতে পেলাম। হিংস্রতা ঠিকরে পড়ছে তাদের চোখ মুখ দিয়ে।  কোনো এক অচেনা ক্ষুধা-তৃষ্ণা যেন তাদের তাড়া করে বেরাচ্ছে। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমার দিকেই চেয়ে আছে তারা।

জানলাটা সুযোগ বুঝে বন্ধ করে দিলাম। তাতেই ঘটল বিপদ। বাদুড় গুলো তাদের ডানা দিয়ে আরও জোরে জোরে আঁচড় কাটতে লাগল জানলার কাঁচে।

        রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম আমি। সত্যিই দেখলাম জানলার কাঁচে ফুটে উঠছে শত শত আঁচড়ের দাগ।

         মনে হচ্ছিল এই যেন সেই আঁচড়ের দাগ আরো গভীর হয়ে যাবে এবং কাঁচ ভেঙে ঘরে ঢুকে আসবে প্রাণীগুলো। একটা চাপা আতঙ্ক বার বার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। মনে হচ্ছিল কোনো এক নারকীয় গ্রহে এসে পড়েছি যেখানে এই বাদুড়রাই সর্বোত্র বিরাজমান। আমিই যেন তাদের বাসায় এসে তাদের বিরক্ত করছি।

 

ভয়ে ভয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। সিড়ির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম।সিড়ির কাছে এসে হাক দিলাম-“নকুল…শৈলেশ…”, কিন্তু কোনো সাড়া মিলল না। কোথায় গেল সব?

          বুকের ভেতরের ভয়টা যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সাহস করে নীচে নামতে শুরু করলাম সিঁড়ি বেয়ে।আমার প্রত্যেক পদক্ষেপের সাথে সাথে সেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হতে লাগল সিড়িতে।

          নীচে নেমেই হাঁক দিলাম আবার,”নকুল…”।এ কোন ভূতুড়ে বাড়িতে এসে পড়লাম রে বাবা! চারদিকে তাকাতে লাগলাম। আশেপাশের আলোগুলো কে যেন হটাৎ করেই নিভিয়ে দিয়েছে। গোটা ঘরটা এখন দুর্ভেদ্য অন্ধকারে ঢাকা। একটি আলোকবিন্দুও চোখে পড়ছে না সারা ঘরে। সামনে হাতরে প্রকান্ড আরামকেদারাটা অনুভব করলাম। বুঝলাম বসার ঘরে এসে পড়েছি।

      হটাৎ পেছন থেকে একটা কর্কশ কন্ঠস্বর শোনা গেল- “বাবু…আমায় খুজছেঁন?” অনেকটা নাকি সুরে বলে উঠল নকুল…নকুল? এই প্রকান্ড তালগাছের সমান অতিকায় জন্তুটি কোনোমতেই নকুল হতে পারে না। 

      তবে এ যে সেই এক গলার স্বর। মাথা তুলেও তার মুখ দেখতে পেলাম না আমি।

“হ্যাঁ, মানে ওপরের ঘরে বাদুড় গুলো খুব উৎপাত শুরু করেছে…”, আস্তে আস্তে ঢোক গিলে বললাম।

     “কি বললেন? বাদুড়…”, সেই এক কর্কশ গলা। ইতিমধ্যে বুঝতে পারলাম বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির ছাঁট  ঘরের খোলা জানলা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে আর মেঝেটাকে ভিজিয়ে তুলছে ধীরে ধীরে।

    “হ্যাঁ,  আমার ঘরের জানালার বাইরে“,বললাম।

“বাদুড় তো আপনি এখনও দেখেন নি। এই দেখুন…”এই বলে হাহা করে হেসে উঠলো সে। নিমেষের মধ্যে আমার চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই অতিকায় সেই শরীরটা বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল আমার চোখের সামনে।

    এবং পরমুহূর্তেই ভেসে উঠল এক নতুন দৃশ্য। আর সেই রকম ভয়াবহ দৃশ্য আমি আগে দেখেছি বলে মনে পরেনা। সামনের জমাট বাঁধা অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে এলো এক ছায়ামূর্তি। শরীরের অবয়বটা চেনা হলেও এই অমানুষিক মুখমন্ডল সম্পূর্ণই আমার অচেনা।

  প্রশ্নটাও এল চেনা এক গলায়-“কিরে ভয় পেয়ে গেলি নাকি?”,এই ফিসফিসে অথচ নারকীয় কন্ঠস্বর কার। শৈলেশের?

পরের কথাগুলো মন দিয়ে শুনে বুঝলাম সত্যিই তা শৈলেশের কন্ঠস্বর।

“কিরে?...”বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে তার কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সারা ঘর জুড়ে।

আমতা আমতা করে বললাম, ”তোর কি গলা বসে গেছে শৈলেশ?”

“গলাই যদি না থাকে তাহলে বসবে কি করে?” ,আবার শোনা গেল সেই হাড় হিম করা স্বর।

“মানে?”

“মানেটা কি এখন বুঝিসনি তুই?”, বেশ জোরে চেচিয়ে উঠল শৈলেশ।

“তুই বলেছিলি না সম্ভব হলে সারাজীবন আমার সাথে এই ভুতুড়ে বাড়িতে থেকে যাবি। “আবার প্রতিধ্বনিত হলো তার গলার স্বর।

“হ্যাঁ , বলেছিলাম তো”

“তাহলে আয়।থেকে যা আমার সাথে” যেন হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। সেই বিদ্যুতের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম সামনের শরীরটাকে।

       মাথা থেকে পা অবধি কালো কাপড়ে ঢাকা। চোখ বলে যেন কোনো বস্তুই নেই। শুধুই দুটো জ্লন্ত কোটড়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। শ্বদন্তগুলো অস্বাভাবিক রকম বড়ো,মুখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। আর ছায়ামূর্তিটার পায়ের দিকে তাকাতেই আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। যেখানে দুটো জলজ্যান্ত পায়ের পাতা থাকার কথা সেখানে কিছুই নেই। ঠিক যেন শূন্যে ভেসে আছে শরীরটা।

“আয়…”আবার বলে উঠল সে।

“কে তুই। তুই তো শৈলেশ নস।বল কে তুই?”

ভয় আড়ষ্ট হয়ে গেছে আমার শরীর। মুখ দিয়ে কথা বেরচ্ছে না আর।

“আগে ছিলাম শৈলেশ। এখন শুধুই একটা ছায়ামূর্তি। সেই শরীরও নেই , সেই শৈলেশও নেই”, এইবারে করুন শোনাল তার কন্ঠস্বরটা।

সাহস করে বললাম,"কি হয়েছে রে তোর ভাই?আমাকে বল। এ বাড়িতে এসে থেকেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে আমার।সারা সন্ধ্যে ঐ বাদুড়গুলো…"

আমার কথা শেষ হলোনা।

মূর্তিটা আবার বলে উঠল-"বাদুড়…মরে যাবার পর তো ওরাই আমার একমাত্র সঙ্গী। ওরা আমার সাথে খেলতে আসে। আমার একাকীত্ব কমে যায় তাতে। আর আমি একা বোধ করিনা।"

        ইতিমধ্যেই শুনতে পেলাম আরও একটা শব্দ। বৃষ্টির শব্দের সাথেই আবার শুনতে পেলাম আমার সেই পরিচিত শব্দটা। বাদুড়ের শব্দ…।

        ঘরের জানলা গুলোর দিকে চোখ যেতেই আঁতকে উঠলাম। জানলার বাইরে এসে জমা হয়েছে হাজার হাজার বাদুড়। অনবরত তারা আঁচড় কাটছে জানলার কাঁচের ওপর।

            আমি ভীত চোখে তাকিয়ে চলেছি একবার মূর্তিটার দিকে ,একবার জানলার দিকে। আমার মানসিক ভারসাম্য ধীরে ধিরে যেন লোপ পাচ্ছে। কিন্তু এখন যে জ্ঞান হারালে চলবেনা।

হটাৎ একটা কাঁচ ভাঙার শব্দ। শব্দটা শুনেই বুকের ভেতরটা বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেল। কোনো একটা জানলার কাঁচ ভেঙে পড়েছে। তারপরই শুনতে পেলাম শত শত বাদুড়ের সমবেত কলরব।

       সে কি হাড়হিম করা শব্দ। কান ফেটে যাবার উপক্রম। বুঝতে পারলাম তারা সবাই এ ঘরে ঢুকে পড়েছে।চতুর্দিকে এলোপাথারি উড়ে বেড়াচ্ছে তারা। মাঝে মাঝেই তাদের ধারালো ডানা আমার মাথা ছুঁয়ে যাচ্ছে।

 “আজ তোদের নতুন বন্ধু এসেছে…আনন্দ কর সবাই…” সব শব্দ ছাপিয়ে আবার সেই গলা শোনা গেল। এতক্ষণে এটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি কোনো এক অতিপ্রাকৃতিক জগতে আটকা পরে গেছি। 

এখান থেকে নিস্তার পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।

     “ছেড়ে দে ভাই …ছেড়ে দে।আমি তো তোর কোনো ক্ষতি করিনি।“ ,প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম আমি।

      কোন কথাই সে গ্রাহ্য করল না।

শুধুই অমানবিক স্বরে অট্টহাস্য করতে লাগল।

সে হাসিতে যেন মিশে আছে কোনো অমঙ্গলের ইঙ্গিত,কোনো অতিপ্রাকৃতিক মায়া, কোনো অলৌকিক আকর্ষণ। সারা ঘরে সেই বাদুড়ের চুইঁ চুইঁ শব্দ আর সেই অট্টহাসি বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

        আমি প্রায় চেতনা হারিয়ে ফেলছিলাম এমন সময় ঝড়ের দমকা হাওয়ায় খুলে গেল সদর দরজা টা। সহসা যেন আমি আশার আলো দেখতে পেলাম। উর্ধশ্বাসে দৌড় দিলাম দরজার উদ্দেশ্যে।

            কোনোরকমে নিজের শরীরটাকে প্রায় ছুঁড়ে ফেললাম দড়জার বাইরে। তারপর আর কোনোদিকে তাকাইনি, কোনোদিকে কান দিইনি।

             প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়েছিলাম। কোনদিকে যাচ্ছি ,তাও বুঝতে পারছিলাম না। কেবল দৌড়েই চলেছি। বৃষ্টির জলে সারা শরীর আপাদমস্তক ভিজে যাচ্ছিল। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা করার সময় তখন আমার হাতে ছিলনা।

        বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কানে আসছিল সেই কর্কশ কন্ঠস্বর-“কোথায় পালাচ্ছিস…আয় ,আয়…”।

মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল পেছন থেকে হয়ত কেউ আমায় তাড়া করছে।

             তবে আমি পিছনে তাকাইনি। প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজের পা দুটোকে যথাসম্ভব দ্রুত চালিয়ে যাচ্ছিলাম। 

কাঁটা গাছে হাত পা ছুলে যাচ্ছিল। প্যান্ট জামা কাদায় মাখামাখি।

       যেন কোনো অনন্ত পথে দৌড়ে চলেছি আমি, কোনো জনবসতিই চোখে পড়ছিলনা। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল আবার হয়তো আমি সেই প্রেতপুরীতেই ফিরে যাচ্ছি।

    প্রায় মাইলখানেক অবিরাম দৌড়ানোর পর একটা ছোট বাড়ি চোখে পড়ল আমায়। একটা মাত্র আলো জ্বলছে সেখানে। বৃষ্টির জলে চোখের পাতা ভিজে গিয়েছিল। তাই সেটা কারোর বাড়ি না কোনো দোকান তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল।

        দৌড়ে গিয়ে দড়জায় কড়া নাড়লাম। মাঝে মাঝেই পিছনে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছিলাম কেউ আদৌ আমার পিছু নিয়েছে কিনা।

    দরজা খুললেন একজন খাকি পড়া ভদ্রলোক। দেখে পুলিশ বলে মনে হয়।

“একটু সাহায্য করুন প্লিজ।আমার খুব বিপদ স্যার”, ভয়ে গলা ধরে গিয়েছে অনুভব করলাম।

“আসুন আসুন।এই মাধব, একটু গরম জল নিয়ে আয় তো” হাক দিলেন ভদ্রলোক।

“আজ্ঞে  এটা কি থানা?”

“হ্যাঁ। আমি এখানকার ওসি।বিমল সান্যাল। আপনি কি কোনো বিপদে পড়েছেন। মানে আমায় নির্দ্বিধায় বলতে পারেন”, বললেন বিমলবাবু।

সন্ধ্যের পর থেকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বিবৃত করলাম তার কাছে।

         সব শুনে ধীরেস্থির গলায় বললেন তিনি-“খুব জোড় প্রাণে বেচে গেছেন আপনি।এটাই আপনার পরম সৌভগ্য।“

“তবে এসব কেন হচ্ছিল আমার সাথে?”

“আপনার সাথে যা যা ঘটেছে তার একটাও আপনার মনের ভুল নয় অসীমবাবু। আপনিই সত্যিই এক অলৌকিক অভিজ্ঞতার সাক্ষী। ও বাড়ির নামে যে এ পাড়ায় কত কুখ্যাতি প্রচলিত আছে তা তো আপনি জানেন না। আর জানবেনই বা কি করে! আপনার বন্ধুর প্রেতাত্মা তো স্বয়ং নিজেই আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ও বাড়িতে যে কিছু একটা গন্ডগোল আছে তা সক্কলেই জানে। “এই বলে থামলেন বিমল দারোগা।

         “তার মানে সত্যিই শৈলেশ আর বেঁচে নেই?”, প্রশ্ন করলাম।

“আজ্ঞে না। শৈলেশ ভট্টাচার্য আজ থেকে তিন বছর আগে আত্মহত্যা করেন। তারই বাড়ির ওপর তলার একটি ঘরে তার মৃতদেহটি পাওয়া যায়। আমি তখন সবে বদলি হয়ে এখানে এসেছি। ঘটনাটা শুনে তো প্রথম থেকেই বেশ রহস্যজনক বলে মনে হয়েছিল আমার। তবে তার দেহ উদ্ধার সবার প্রথমে করেছিল এ পাড়ারই কিছু লোকজন। কোনোদিনই শৈলেশ ভট্টাচার্য পাড়ার লোকের সাথে মেলামেশা করতেন না। সবসময়ই এক থাকতেন তিনি। বিয়েও করেননি। একটা চাকর ছিল। দেহ উদ্ধারের পর তাকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেও বেমালুম নিখোঁজ হয়ে গেছিল।

       পাড়ার লোকজন বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে পচা গন্ধ পেয়েছিল। কেউ কেউ সাহস করে ভেতরে যায় আর দেহটিকে দেখতে পায়। সিলিং ফ্যান থেকে বডি ঝুলছে।আর তারই সাথে সিলিং থেকে ঝুলে আছে হাজার হাজার বাদুড়।

          অত বাদুড় একসাথে নাকি পাড়ার লোকজন কোনোদিন দেখেনি। এ পড়ায় যে অতগুলো বাদুড় একসাথে একটা ঘরে বাস করে তাও তারা বিশ্বাস করেনি।“

থামলেন বিমলবাবু।

 

“বাদুড়…সেই বাদুড়ই তো এই দুদিন আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তবে কি এইসবের সাথে ঐ বাদুড়গুলোর কিছু যোগাযোগ আছে?”, জিজ্ঞেস করলাম।

“হতেই পারে। তবে এর ব্যাখ্যা আমি আজও খুজে পাইনি।“, গম্ভীর স্বরে বললেন তিনি।

“এর পর থেকেই ঐ বাড়ি হানাবাড়ি তে পরিণত হয়। রাত হলেই ও বাড়ির ধারেকাছে কেউ যায় না। দিনের বেলাতেও সবাই এড়িয়ে চলে ও বাড়ি কে। 

     আপনি সেলসম্যানের ঘটনা টা জানেন তো?”, প্রশ্ন করল দারোগা।

“না তো। তবে আজ সকালে একজনের মুখে শুনেছিলাম তার কথা ।“

“তবে শুনুন।“, একটা কন্স্টেবল এসে এক গ্লাস গরম জল দিযে গেল। তেষ্টা পেয়েছিল খুব। এক চুমুকে খেয়ে ফেললাম জলটা।

বিমলবাবু বলে চললেন- “মাস তিনেক আগেকার ঘটনা। এমনিই এক বৃষ্টি বাদলার দিনে একটি সেলসম্যান ঝড়জল থেকে বাঁচার জন্য ঐ বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেও ছিল এ পাড়ায় নতুন। নতুন নতুন চাকরিতে ঢুকেছিল সে। বৈদ্যবাটির এ পাড়ার এই বাড়ির কুখ্যাতি সম্বন্ধে কিছুই জানত না সে। 

      পরের দিন সকালে তার মৃতদেহটি পাওয়া যায় বাড়ির উঠ্নে। কোনো হিংস্র ক্ষুধার্ত প্রাণী যেন তার সারা গায়ে নখ দিয়ে আঁচড় কেটে দিয়ে গেছে। তবে পাড়ার কেউই এমন কোনো প্রাণীর কথা এ অঞ্চলে কোনোদিন শুনেছে বলে দাবি করেনি। সকলের কাছেই সেই মৃত্যু ছিল অতিরহস্যজনক। পোস্ট মর্টেমেও ঐ একই কথা বলেছিল। কোনো প্রাণীর নখের আঘাতে মৃত্যু। শোনা যায় নখের আঘাতে তার হৃদপিণ্ড টাও একেবারে ফুটো হয়ে গেছিল। 

    তারপর থেকেই ও বাড়ির ধারে কাছে কেউ ভুলেও ঘেঁষেনা।

আপনার কপাল ভালো তাই বেঁচে গেছেন।“ বিমলবাবুর চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম তিনি ভয় পেয়েছেন। 

     আর আমি। ভয়ের চেয়ে বিস্ময় তখন আমায় বেশি জোড়ে চেপে ধরেছে।

সব শুনে একটাই জিনিস বুঝলাম। এ যাত্রায় খুব জোড় বেঁচে গেছি আমি।

আর বেশিক্ষণ বৈদ্যবাটির ত্রিসীমানায় থাকিনি। কোনোরকমে রাত টা থানায় কাটিয়ে পরের দিন ভোরেই কলকাতার ট্রেন ধরেছিলাম।

        অবশ্য বিমলবাবুর দুজন কন্স্টেবল আমার ব্যাগপত্র ও বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল। বিমলবাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিয়েছিলাম।

      জীবনে আর কোনোদিন ও মুখো হইনি। তবে কিছু কিছু কথা আজীবন রহস্যই রয়ে গিয়েছিল।

     কেনই বা শৈলেশের মতন একজন প্রাণচ্ছল ছেলে এমনভাবে আত্মহত্যা করতে গেল? আর সেলসম্যানের সাথে যা ঘটেছিল আমার কপালেও তো তাই লেখা ছিল। তবে হাতের সামনে পেয়েও আমায় ছেড়ে দিল কেন সে?

  ছেলেবেলার বন্ধু বলে কি?